আয় বৃষ্টি ঝেপে
ধান দেবো মেপে
লেবুর পাতা করমচা
যা বৃষ্টি ঝরে যা।
গ্রামীণ লোক সমাজে বর্ষায় নানা ধরনের লোক উৎসব ও আচার অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ যেহেতু নদী মাতৃক দেশ, সেহেতু বর্ষায় বাংলার নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওর, ডোবা-নালা, মাঠ-ঘাট বর্ষার পানিতে টইটম্বুর থাকে। তখন কৃষিপ্রধান এই দেশের মানুষ প্রচুর অবসর সময় পায়। গ্রামের রাখাল, কৃষক, গিরস্ত তখন অবসর সময়ে ঘেঁটু গান, জারি গান, গাজীর গীত এর আসর বসায়। অপর দিকে গ্রামের বউ ঝিয়েরা মেয়েলি গীত, বারমাসি, বিচ্ছেদি গান, সখিসখা ও প্রতিবেশিদের নিয়ে গীত করে থাকে। হাওর অঞ্চলের ছেলে মেয়েদের বিয়ে বর্ষা কালেই হয়ে থাকে। ঐ সব বিয়ে বাড়িতে তখন ধামাইল গান ও বিয়ের গীত মা চাচিরা সমস্বরে গেয়ে থাকে। জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড তাপদাহ অতিক্রম করে যখন আষাঢ় মাসের আগমন ঘটে, প্রকৃতিগত কারণে অনেক সময় আষাঢ়ের প্রথম দিকেও বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায় না। তখন গ্রামীণ লোকমানুষ, বৃষ্টিকে আমন্ত্রণ জানানোর বিভিন্ন লৌকিক আচার, অনুষ্ঠান ও লোকউৎসব করে থাকে। ‘কুলানামান’ তেমন একটি উৎসব। নারীরা এই উপলক্ষে কুলা সাজিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি যায় এবং বৃষ্টিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে গান গায়। বর্ষার গানকে বলা হয় কাজরী।
‘আম্বুবাচি’ তেমন একটি আষাঢ়ি লোক উৎসব বা তিথি বিশেষ। আষাঢ় মাসের সাত তারিখ হতে শুরু করে তিন দিন এই উৎসব পালন করা হয়। ‘আম্বুবাচি’ উৎসবের লোক বিশ্বাসটি হল, আষাঢ়ের সাত তারিখ হতে তিন দিন পৃথিবী ও আকাশের মিলন ঘটে। তখন পৃথিবী সিক্ত হয় ও কৃষিকাজের উপযুক্ত হয়। এ সময় জমিতে হালচাষ করা, মাটিতে গর্ত করা বা খোড়া নিষেধ। ‘বৃষ্টি আবাহন’ এটিও বৃষ্টিকে আহ্বান জানানোর উৎসব। এছারাও বৃষ্টিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নানা ধরনের লোকাচার ও ব্রত পালন করা হয়ে থাকে। যেমন ‘ব্যাঙা ব্যাঙির’ বিয়া, ‘বদনা’ বিয়া, ‘মেঘ রানী’, ‘বসুধারা ব্রত’, ‘কাদা মাটি’ অনুষ্ঠান। অতিবৃষ্টি থেকে পরিত্রাণের জন্য লোক সমাজে হয়ে থাকে ‘গোদা গুদির’ বিয়া, ‘মেঘা মেঘির’ বিয়া। লোক আচার, অনুষ্ঠান, উৎসব মানেই লোক গান, লোক গান ছাড়া লোক সমাজে লোক উৎসব কল্পনা করা যায় না।
কিছু আষাঢ় শ্রাবণের গীত
ব্যাঙ ব্যাঙ যতনের ব্যাঙ
বৃষ্টি আইলে মেলে ঠেঙ ,
ব্যাঙ বর রশিয়
বেলা দি প্রহর, ধুধু বালু চর, ধুপেতে কলিজা ফাটে, তিয়াশে কাতর।
আল্লা মেঘদে পানিদে ছায়াদেরে তুই আল্লা মেঘদে
আসমান হইল টুডা টুডা জমিন হইল ফাডা
মেঘ রাজা ঘুমাইয়া রইছে মেঘ দিব তর কেডা।।
হালের গরু বাইন্দা গিরছ মরে কাইন্দা
ঘড়ের রমণী মরে ডাইল খিছুরি রাইন্দা।
ফাইটা,ফাইটা রইছে যত খালা বিলা নদী
পানির লাইগা কাইন্দা মরে পঙ্খী জলজি।।
কপত কপতি কান্দে খোপেতে বসিয়া
সুখনা ফুলের কলি পরে ঝরিয়া ঝরিয়া।।
আষাঢ়ের কোন ভেজা পথে এল ও এলরে/এল আবার ঘর ভাঙ্গা শ্রাবণ/
এমনি দিনে লেগেছে মনের কোলে ভাঙ্গন/এল আবার দুরন্ত শ্রাবণ/
চুরনি নদী ঘূর্ণি পাকে যেথায় পড়ল চর/সেই চরেতে বেধে ছিলাম বসতি এক ঘর/
সেই ঘর ভেসে গেল দিন কয় এক পর
পুবালি বাতাসে বাদাম দেখলে চাইয়া থাকি
আমার না কেউ আসে দারুন আষাঢ় মাস ওরে।।
যেদিন হইতে বর্ষার পানি আইল আমার ঘাটে
অভাগিনির মনে তখন কত কথা উঠে।
ভাই আমায় নিলানা নায়র পানি থাকতে তাজা
দিনের পথে দিনে যাইতাম রাস্তা হইত সুজা।
ভাগ্য যার ঐ নাইয়র যাওয়া আসা করে
উকিল আলির তুশের নাইয়র কার্তিক মাসের শেষে।।
শ্রাবন আসিল মাঠে জলের পশরা
পাথর ভাসাইয়া বহে শাউনিয়া ধারা।।
দিন রাতি ভেদ নাই মেঘে বর্ষে পানি
কুল ছাপাইয়া জলে ডুবায় ছাউনি।।
খাউরি বিউনা করে যত ডুমের নারী
কত দেশে যায় তারা বাহিয়া না তরী।।
মেঘ রাজারে তুই আমার সুন্দর ভাই
এক ঘুরি মেঘের লাইগা দুয়ার বিজ্জা যায়।।
ব্যাঙের জিয়ের বিয়া সোনার মেডল দিয়া
আলো ব্যাঙই মেঘ দিয়া যা।।
ঘুরা খাইল লোকে ধান খাইল পোকে
মেঘা মেঘি বইয়া রইছে গাংগের কুলে।।
মেঘ দিলায় যেমন তেমন উডান বিজলনা
নবী সইত্যে আল্লায় কেনে মেঘ দিলায়না।।
ঘড় বিজ্জা যাইতে যাইতে মনায় মারল ফাল
এক উশটাদা ফালাই দিয়াম কচুখেতের ফাইল।।
কচু পাতায় পানি উডি টলমল করে
আমার চোখের পানি উডি বুক বাইয়া পরে।।
সহায়ক গ্রন্থ -
১। ফহমিদা হক, ‘বাংলার লোকউৎসব বেড়া ভাসান’ বাংলা একাডেমী।
২।সুমনকুমার দাশ, ‘বাংলাদেশের ধামাইল গান’ বাংলা একাডেমী।